দাওয়াত
وَلۡتَکُنۡ مِّنۡکُمۡ اُمَّۃٌ یَّدۡعُوۡنَ اِلَی الۡخَیۡرِ وَ یَاۡمُرُوۡنَ بِالۡمَعۡرُوۡفِ وَ یَنۡهَوۡنَ عَنِ الۡمُنۡکَرِ ؕ وَ اُولٰٓئِکَ هُمُ الۡمُفۡلِحُوۡنَ ﴿۱۰۴﴾
আর তোমাদের মধ্যে এমন একটা দল থাকা উচিত যারা আহবান জানাবে সৎকর্মের প্রতি, নির্দেশ দেবে ভাল কাজের এবং বারণ করবে অন্যায় কাজ থেকে, আর তারাই হলো সফলকাম। (সুরা আলে ইমরান : ১০৪)
کُنۡتُمۡ خَیۡرَ اُمَّۃٍ اُخۡرِجَتۡ لِلنَّاسِ تَاۡمُرُوۡنَ بِالۡمَعۡرُوۡفِ وَ تَنۡهَوۡنَ عَنِ الۡمُنۡکَرِ وَ تُؤۡمِنُوۡنَ بِاللّٰهِ ؕ وَ لَوۡ اٰمَنَ اَهۡلُ الۡکِتٰبِ لَکَانَ خَیۡرًا لَّهُمۡ ؕ مِنۡهُمُ الۡمُؤۡمِنُوۡنَ وَ اَکۡثَرُهُمُ الۡفٰسِقُوۡنَ ﴿۱۱۰﴾
তোমরাই হলে সর্বোত্তম উম্মত, মানবজাতির কল্যানের জন্যেই তোমাদের উদ্ভব ঘটানো হয়েছে। তোমরা সৎকাজের নির্দেশ দান করবে ও অন্যায় কাজে বাধা দেবে এবং আল্লাহর প্রতি ঈমান আনবে। আর আহলে-কিতাবরা যদি ঈমান আনতো, তাহলে তা তাদের জন্য মঙ্গলকর হতো। তাদের মধ্যে কিছু তো রয়েছে ঈমানদার আর অধিকাংশই হলো পাপাচারী। (সুরা আলে ইমরান : ১১০)
আবূ নাজীহ (রাঃ)-এর ইসলাম গ্রহণ
আবূ নাজীহ আমর ইবনু আবাসাহ আস-সুলামী (রাঃ) বলেন, জাহেলী যুগে আমি ধারণা করতাম যে, লোকেরা পথভ্রষ্টতার উপর রয়েছে এবং এরা কোন ধর্মেই নেই। আর ওরা প্রতিমা পূজা করছে। অতঃপর আমি এক ব্যক্তির ব্যাপারে শুনলাম যে, তিনি মক্কায় অনেক আশ্চর্য খবর বলছেন। সুতরাং আমি আমার সওয়ারীর উপর বসে তাঁর কাছে এসে দেখলাম যে, তিনি আল্লাহর রাসূল (দ)। তিনি গোপনে (ইসলাম প্রচার করছেন), আর তাঁর সম্প্রদায় (মুশরিকরা) তাঁর প্রতি দুর্ব্যবহার করছে। সুতরাং আমি বিচক্ষণতার সাথে কাজ করলাম। আমি মক্কায় তাঁর কাছে প্রবেশ করলাম। অতঃপর আমি তাঁকে বললাম, আপনি কে? তিনি বললেন, ‘আমি নবী’। আমি বললাম, নবী কি? তিনি বললেন, ‘মহান আল্লাহ আমাকে প্রেরণ করেছেন’। আমি বললাম, তিনি কি নির্দেশ দিয়ে প্রেরণ করেছেন? তিনি বললেন, ‘আত্মীয়তার সম্পর্ক অক্ষুণ্ণ রাখা, মূর্তি ভেঙ্গে ফেলা, আল্লাহকে একক উপাস্য মানা এবং তাঁর সাথে কাউকে শরীক না করার নির্দেশ দিয়ে’। আমি বললাম, এ কাজে আপনার সঙ্গে কে আছে? তিনি বললেন, “একজন স্বাধীন এবং একজন কৃতদাস’। তিনি বলেন, তার প্রতি যারা ঈমান এনেছিল তার মধ্যে তখন তাঁর সঙ্গে আবূ বকর ও বেলাল (রাঃ) ছিলেন। আমি বললাম, আমিও আপনার অনুগত। তিনি বললেন, ‘তুমি এখন এ কাজ কোন অবস্থাতেই করতে পারবে না। তুমি কি আমার অবস্থা ও লোকদের অবস্থা দেখতে পাচ্ছ না? অতএব তুমি (এখন) বাড়ি ফিরে যাও। অতঃপর যখন তুমি আমার জয়ী ও শক্তিশালী হওয়ার সংবাদ পাবে, তখন আমার কাছে এস’।
সুতরাং আমি আমার পরিবার-পরিজনের নিকট চলে গেলাম এবং রাসূলুল্লাহ (দ) মদীনায় চলে এলেন। আর আমি পরিবারের সদস্যদের সাথেই ছিলাম। অতঃপর আমি খবরাখবর নিতে আরম্ভ করলাম এবং যখন তিনি মদীনায় আগমন করলেন, তখন আমি (তাঁর ব্যাপারে) লোকদেরকে জিজ্ঞেস করতে লাগলাম। অবশেষে আমার নিকট মদীনার কিছু লোক এল। আমি বললাম, ঐ লোকটার অবস্থা কি, যিনি (মক্কা ত্যাগ করে) মদীনায় এসেছেন? তারা বলল, লোকেরা তাঁর দিকে দ্রুত ধাবমান। তাঁর সম্প্রদায় তাঁকে হত্যা করার ইচ্ছা করেছিল; কিন্তু তারা তা করতে সক্ষম হয়নি।
অতঃপর আমি মদীনায় এসে তাঁর খিদমতে হাযির হ’লাম। তারপর আমি বললাম, ‘হে আল্লাহর রাসূল (দ)! আপনি কি আমাকে চিনতে পেরেছেন? তিনি বললেন, ‘হ্যাঁ, তুমি তো ঐ ব্যক্তি, যে মক্কায় আমার সাথে সাক্ষাৎ করেছিলে’। আমি বললাম, হ্যাঁ। হে আল্লাহর রাসূল (দ)! আল্লাহ তা’আলা আপনাকে যা শিক্ষা দিয়েছেন এবং যা আমার অজানা, তা আমাকে বলুন? আমাকে ছালাত সম্পর্কে বলুন? তিনি বললেন, তুমি ফজরের ছালাত পড়। তারপর সূর্য এক বল্লম পরিমাণ উঁচু হওয়া পর্যন্ত বিরত থাক। কারণ তা শয়তানের দু’শিং-এর মধ্যভাগে উদিত হয় (অর্থাৎ এ সময় শয়তানরা ছড়িয়ে পড়ে) এবং সে সময় কাফেররা তাকে সিজদা করে। পুনরায় তুমি ছালাত আদায় কর। কেননা ছালাতে ফেরেশতা সাক্ষী ও উপস্থিত হন, যতক্ষণ না ছায়া বল্লমের সমান হয়ে যায়। অতঃপর ছালাত থেকে বিরত হও। কেননা তখন জাহান্নামের আগুন উস্কানো হয়। অতঃপর যখন ছায়া বাড়তে আরম্ভ করে, তখন ছালাত আদায় কর। কেননা এ ছালাতে ফেরেশতা সাক্ষী ও উপস্থিত হন। পরিশেষে তুমি আছরের ছালাত আদায় কর। অতঃপর সূর্যাস্ত পর্যন্ত ছালাত আদায় করা থেকে বিরত থাক। কেননা সূর্য শয়তানের দু’শিং-এর মধ্যে অস্ত যায় (অর্থাৎ এ সময় শয়তানরা ছড়িয়ে পড়ে) এবং তখন কাফেররা তাকে সিজদা করো।
পুনরায় আমি বললাম, “হে আল্লাহর নবী (ছাঃ)! আপনি আমাকে ওযূ সম্পর্কে বলুন’? তিনি বললেন, “তোমাদের মধ্যে যে কেউ পানি নিয়ে (হাত ধোয়ার পর) কুলি করবে এবং নাকে পানি নিয়ে ঝেড়ে পরিষ্কার করবে, তার চেহারা, তার মুখ এবং নাকের গুনাহসমূহ ঝরে যায়। অতঃপর সে যখন আল্লাহর আদেশ অনুযায়ী তার চেহারা ধৌত করে, তখন তার চেহারার পাপরাশি তার দাড়ির শেষ প্রান্তের পানির সাথে ঝরে যায়। তারপর সে যখন তার হাত দু’খানি কনুই পর্যন্ত ধৌত করে, তখন তার হাতের পাপরাশি তার আঙ্গুলের পানির সাথে ঝরে যায়। অতঃপর সে যখন তার মাথা মাসাহ করে, তখন তার মাথার পাপরাশি চুলের ডগার পানির সাথে ঝরে যায়। তারপর সে যখন তার পা দু’খানি গিট পর্যন্ত ধৌত করে, তখন তার পায়ের পাপরাশি তার আঙ্গুলের পানির সাথে ঝরে যায়। অতঃপর সে যদি দাড়িয়ে ছালাত আদায় করে, আল্লাহর প্রশংসা ও তার মাহাত্ম্য বর্ণনা করে, যার তিনি যোগ্য এবং অন্তরকে আল্লাহ তা আলার জন্য খালি করে, তাহ’লে সে ঐ দিনের মত নিষ্পাপ হয়ে বেরিয়ে আসে, যেদিন তার মা তাকে প্রসব করেছিল।
তারপর আমর ইবনু আবাসাহ (রাঃ) এ হাদীছটি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর ছাহাবী আবূ উমামা (রাঃ)-এর নিকট বর্ণনা করলেন) আবূ উমামাহ (রাঃ) তাঁকে বললেন, “হে আমর ইবনু আবাসাহ! তুমি যা বলছ, তা চিন্তা করে বল! একবার ওযু করলেই কি এই ব্যক্তিকে এতটা মর্যাদা দেওয়া হবে? আমর বললেন, হে আবূ উমামাহ! আমার বয়স ঢের হয়েছে, আমার হাড় দুর্বল হয়ে গেছে এবং আমার মৃত্যুও নিকটবর্তী। (ফলে এ অবস্থায়) আল্লাহ তা’আলা অথবা রাসূলুল্লাহ (দ)-এর প্রতি মিথ্যারোপ করার কি প্রয়োজন আছে? যদি আমি এটি রাসূলুল্লাহ (দ)-এর নিকট থেকে একবার, দু’বার, তিনবার এমনকি সাতবার পর্যন্ত না শুনতাম, তাহ’লে কখনোই তা বর্ণনা করতাম না। কিন্তু আমি তাঁর নিকট এর চেয়েও অধিকবার শুনেছি’।
(মুসলিম) হা/৮৩২, মুসাফিরের ছালাত’ অধ্যায়)
শিক্ষা :
- দ্বীনী বিষয় জানার জন্য আগ্রহ থাকতে হবে।
- পাঁচ ওয়াক্ত ছালাত আউয়াল ওয়াক্তে আদায় করতে হবে।
- ওযূর মাধ্যমে বান্দা তার পাপরাশি মোচন করে নিতে পারে।
ইতিকাফ করা সুন্নাত
রমজানের শেষ দশক ইতিকাফ করা সুন্নতে মুয়াক্কাদাহ কিফায়াহ। এর কম যে কোনো পরিমাণ সময় ইতিকাফ করলে তা নফল ইতিকাফ হিসেবে গণ্য হবে। নফল ইতিকাফও অত্যন্ত ফজিলতপূর্ণ আমল; তাই সম্পূর্ণ সুন্নত ইতিকাফ পালন করতে না পারলে যতদূর সম্ভব নফল ইতিকাফ করাও গুরুত্বপূর্ণ। নফল ইতিকাফ বছরের যে কোনো সময়ই করা যায়। ইতিকাফের জন্য রোজা শর্ত; কিন্তু রমজানের বাইরে স্বল্প সময় (একদিনের কম সময়) ইতিকাফ করলে তার জন্য রোজার শর্ত নয়। পূর্ণদিবস ইতিকাফের জন্য রোজা শর্ত। নফল ইতিকাফ মান্নত করলে বা আরম্ভ করে ছেড়ে দিলে, তা পূর্ণ করা ওয়াজিব। এর জন্যও রোজা শর্ত এবং এটি একদিনের (চব্বিশ ঘণ্টা) কমে হবে না। (মাজমুআ ফাতওয়া)।
আল্লাহর পাকড়াও থেকে নিশ্চিত হওয়া
রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ কথাটি বেশি বলতেন-
«يا مقلب القلوب ثبت قلوبنا على دينك فقيل له يا رسول الله أتخاف علينا فقال رسول الله : إن القلوب بين إصبعين من أصابع الرحمن. يقبلها كيف يشاء».
“হে অন্তর পরিবর্তনকারী! আপনি আমাদের অন্তরকে আপনার দীনের ওপর অটল রাখুন । অতঃপর তাকে জিজ্ঞাসা করা হলো, হে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, আপনি কি আমাদের ঈমানের ব্যাপারে আশংকা করেন? রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম উত্তর দিলেন, মানুষের অন্তর দয়াময় আল্লাহরই দুই আঙ্গুলের মাঝে, তিনি যেভাবে ইচ্ছা করেন সেভাবে পরিবর্তন করেন।” (তিরমিযী, হাদীস নং ২০৬৬)
সুতরাং হে মুসলিম ভাইয়েরা! আপনাদের ঈমান, আমল, সালাত ও সকল প্রকার নেক আমল যতই বেশি ও সুন্দর হোক না কেন, অহংকার করবেন না। কারণ, এগুলো আল্লাহর দয়া ছাড়া আর কিছু নয়। যদি কোনো না কোনো সময় তিনি এগুলো আপনার থেকে ছিনিয়ে নিয়ে যান, তখন আপনি উটের পেটের চেয়েও বেশি খালী হয়ে যাবেন। আপনি আপনার আমলের কারণে গর্ব করা থেক বিরত থাকুন এবং এমন কথা বলবেন না, যা অজ্ঞ ও মূর্খরা বলে। যেমন আমরা অমুকের চেয়ে ভালো। আমার আল্লাহ তো মানুষের অন্তরের গোপন প্রকাশ্য সকল বিষয়ে অবগত। আপনার দুর্বলতা, গুনাহের আধিক্য, আমল কম হওয়ার অনুভুতি অন্তরে স্থান দিয়ে সর্বদা আল্লাহর ভয়ে ভীত থাকুন এবং এমন একটি অবস্থায় থাকুন, যে অবস্থার বর্ণনা রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম হাদীসে দিয়েছেন:
তিনি বলেন,
«أملك عليك لسانك، وليسعك بيتك، وابك على خطيئتك».
“তোমার সংসারে ব্যস্ততা সত্ত্বেও তুমি জিহ্বাকে সংযত রাখবে, গুনাহের কাজের ওপর কান্নাকাটি করবে।” (তিরমিযী)
ঐসব লোকদের মতো হয়ো না যাদের সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿أَفَأَمِنُواْ مَكۡرَ ٱللَّهِۚ فَلَا يَأۡمَنُ مَكۡرَ ٱللَّهِ إِلَّا ٱلۡقَوۡمُ ٱلۡخَٰسِرُونَ ٩٩﴾ [الاعراف: ٩٩]
“তারা কি আল্লাহর পাকড়াও-এর ব্যাপারে নির্ভয় হয়ে গেছে? ক্ষতিগ্রস্ত লোকজন ব্যতীত কেউ আল্লাহর পাকড়াও থেকে নির্ভয় হয় না।” [সূরা আল-আ‘রাফ, আয়াত: ৯৯]
বস্তুতঃ আল্লাহর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা কর এবং সর্বদা এ কথাগুলো বলতে থাক-
«يا مقلب القلوب ثبت قلوبنا على دينك».
“হে অন্তরের পরিবর্তকারী! তুমি আমাদের অন্তরকে তোমার দীনের ওপর অটল অবিচল রাখ।”