ফেরেশতা
وَ لَا یَاۡمُرَکُمۡ اَنۡ تَتَّخِذُوا الۡمَلٰٓئِکَۃَ وَ النَّبِیّٖنَ اَرۡبَابًا ؕ اَیَاۡمُرُکُمۡ بِالۡکُفۡرِ بَعۡدَ اِذۡ اَنۡتُمۡ مُّسۡلِمُوۡنَ ﴿۸۰﴾
আর তিনি তোমাদেরকে নির্দেশ করেন না যে, তোমরা ফেরেশতা ও নবীদেরকে রব রূপে গ্রহণ কর। তোমরা মুসলিম হওয়ার পর তিনি কি তোমাদেরকে কুফরীর নির্দেশ দিবেন? (সুরা আলে ইমরান-৮০)
بَلٰۤی ۙ اِنۡ تَصۡبِرُوۡا وَ تَتَّقُوۡا وَ یَاۡتُوۡکُمۡ مِّنۡ فَوۡرِهِمۡ هٰذَا یُمۡدِدۡکُمۡ رَبُّکُمۡ بِخَمۡسَۃِ اٰلٰفٍ مِّنَ الۡمَلٰٓئِکَۃِ مُسَوِّمِیۡنَ ﴿۱۲۵﴾
হ্যাঁ, যদি তোমরা ধৈর্য ধর এবং তাকওয়া অবলম্বন কর, আর তারা হঠাৎ তোমাদের মুখোমুখি এসে যায়, তবে তোমাদের রব পাঁচ হাজার চিহ্নত ফেরেশতা দ্বারা তোমাদেরকে সাহায্য করবেন। (সুরা আলে ইমরান-১২৫)
قُلۡ یَتَوَفّٰىکُمۡ مَّلَکُ الۡمَوۡتِ الَّذِیۡ وُکِّلَ بِکُمۡ ثُمَّ اِلٰی رَبِّکُمۡ تُرۡجَعُوۡنَ ﴿۱۱﴾
বল, ‘তোমাদেরকে মৃত্যু দেবে মৃত্যুর ফেরেশতা যাকে তোমাদের জন্য নিয়োগ করা হয়েছে। তারপর তোমাদের রবের নিকট তোমাদেরকে ফিরিয়ে আনা হবে’। (সুরা সাজদাহ-১১)
وَ کَمۡ مِّنۡ مَّلَکٍ فِی السَّمٰوٰتِ لَا تُغۡنِیۡ شَفَاعَتُهُمۡ شَیۡئًا اِلَّا مِنۡۢ بَعۡدِ اَنۡ یَّاۡذَنَ اللّٰهُ لِمَنۡ یَّشَآءُ وَ یَرۡضٰی ﴿۲۶﴾
আর আসমানসমূহে অনেক ফেরেশতা রয়েছে, তাদের সুপারিশ কোনই কাজে আসবে না। তবে আল্লাহ যাকে ইচ্ছা করেন এবং যার প্রতি তিনি সন্তুষ্ট, তার ব্যাপারে অনুমতি দেয়ার পর। (সুরা নজম-২৬)
দোলনায় কথা বলা তিন শিশু
আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত,রাসূলুল্লাহ (সা:) বলেন,(বনী ইসরাঈলের মধ্যে) তিন ব্যক্তি ছাড়া আর কেউই দোলনায় কথা বলেনি।
(১) ঈসা ইবনে মারইয়াম: মারইয়াম (আঃ)-এর গর্ভে ঈসা (আঃ) অলৌকিক ভাবে জন্মগ্রহণ করলে লোকজন তার ব্যাপারে সন্দিহান হ’ল। তখন মারইয়াম (আঃ)-এর ইঙ্গিতে ঈসা (আঃ) তাঁর মাতার পক্ষ থেকে জবাব দিয়ে বললেন,‘আমি আল্লাহর দাস। তিনি আমাকে কিতাব (ইনজীল) প্রদান করেছেন এবং আমাকে নবী করেছেন’। ‘আমি যেখানেই থাকি, তিনি আমাকে বরকতময় করেছেন। তিনি আমাকে জোরালো নিদের্শ দিয়েছেন যতদিন জীবিত থাকি,ততদিন ছালাত ও যাকাত আদায় করতে এবং আমার মায়ের অনুগত থাকতে। আল্লাহ আমাকে উদ্ধত ও হতভাগা করেননি’। ‘আমার প্রতি শান্তি যেদিন আমি জনমগ্রহণ করেছি,যেদিন আমি মৃত্যুবরণ করব এবং যেদিন জীবিত পুনরুত্থিত হব’ [মারিয়াম ১৯/২৯-৩৩)]
(২) ছাহেবে জুরাইজ (জুরাইজের সাথে সংশিলষ্ট একটি বাচচা): জুরাইজ একজন আবেদ বান্দা ছিলেন। তিনি নিজের জন্য একটি ইবাদতগাহ তৈরী করলেন। তিনি সেখানে থাকা অবস্থায় একদিন তার মা সেখানে আসলেন। এ সময় তিনি ছালাতে রত ছিলেন। তার মা বললেন, ‘হে জুরাইজ! তখন তিনি (মনে মনে) বলেন,‘হে প্রভু! একদিকে আমার ছালাত আর অন্যদিকে আমার মা’। জুরাইজ ছালাতেই রত থাকলেন। তার মা চলে গেলেন।পরবর্তী দিন তার মা আসলেন । এবারও তিনি ছালাতে মগ্ন ছিলেন। তার মা তাকে ডাকলেন,‘হে জুরাইজ’! তিনি (মনে মনে) বলেন,‘হে প্রভু! একদিকে আমার ছালাত আর অন্যদিকে আমার মা’। তিনি তার ছালাতেই ব্যস্ত থাকলেন। এভাবে তৃতীয় দিনেও জুরাইজ একই কাজ করলে তার মা বললেন, ‘হে আল্লাহ! একে তুমি যেনাকারী নারীর মুখ না দেখা পর্যন্ত মৃত্যু দিও না’।
বনী ইসরাঈলের মধ্যে জুরাইজ ও তার ইবাদতের কথা আলোচিত হ’তে লাগল। এক ব্যভিচারী নারী ছিল। সে উলেলখযোগ্য রূপ-সৌন্দযের্র অধিকারিণী ছিল। সে বলল,তোমরা যদি চাও, আমি তাকে (জুরাইজ) বিভ্রান্ত করতে পারি। সে তাকে ফুসলাতে লাগল,কিন্তু তিনি সেদিকে ভ্রূক্ষেপ করলেন না। অতঃপর সে তার ইবাদতগাহের কাছাকাছি এলাকায় এক রাখালের কাছে আসল। সে নিজের উপর তাকে অধিকার দিল এবং উভয়ে ব্যভিচারে লিপ্ত হ’ল। এতে সে গর্ভবতী হ’ল। সে বাচচা প্রসব করে বলল, এটা জুরাইজের সন্তান। বনী ইসরাঈল (ক্ষিপ্ত হয়ে) তার কাছে এসে তাকে ইবাদতগাহ থেকে বের করে আনল,তার ইবাদতগাহ ধূলিসাৎ করে দিল এবং তাকে মারধর করতে লাগল।
জুরাইজ বললেন,তোমাদের কি হয়েছে? তারা বলল,তুমি এই নষ্টা মহিলার সাথে যেনা করেছ। ফলে একটি শিশু ভূমিষ্ঠ হয়েছে। তিনি বললেন,শিশুটি কোথায়?তারা শিশুটিকে নিয়ে আসল। জুরাইজ বললেন,আমাকে একটু সুযোগ দাও ছালাত আদায় করে নেই। তিনি ছালাত আদায় করলেন। ছালাত শেষ করে তিনি শিশুটির কাছে এসে তার পেটে খোঁচা মেরে জিজ্ঞেস করলেন,‘এই শিশু! তোমার পিতা কে’? সে বলল,‘আমার পিতা অমুক রাখাল’। উপস্থিত লোকেরা তখন জুরাইজের নিকটে এসে তাকে চুম্বন করতে লাগল এবং তার শরীরে হাত বুলাতে লাগল। আর তারা বলল,এখন আমরা তোমার ইবাদতগাহটি সোনা দিয়ে তেরী করে দিচিছ। তিনি বললেন,দরকার নেই,বরং পূর্বের মত মাটি দিয়েই তৈরী করে দাও। অতঃপর তারা তাই করল।
(৩) একটি শিশু তার মায়ের দুধ পান করছিল। এমন সময় একটি লোকদ্রুতগামী ও উন্নত মানের একটি পশুতে সওয়ার হয়ে সেখান দিয়ে যাচিছল। তার পোষাক-পরিচছদ ছিল উন্নত। শিশুটির মা বলল,‘হে আল্লাহ! আমার ছেলেটিকে এই ব্যক্তির মত যোগ্য কর’। শিশুটি দুধ পান ছেড়ে দিয়ে লোকটির দিকে এগিয়ে এসে তাকে দেখতে লাগল। অতঃপর বলল,‘হে আল্লাহ! আমাকে এই ব্যক্তির মত কর না’। অতঃপর ফিরে এসে পুনরায় মায়ের দুধ পান করতে লাগল। (বর্ণনাকারী বলেন) আমি যেন এখনও দেখছি রাসূলুল্লাহ (সা:) শিশুটির দুধ পানের চিত্র তুলে ধরছেন এবং নিজের তর্জনী মুখে দিয়ে চুষছেন। তিনি বলেন,লোকেরা একটি বাঁদিকে মারতে মারতে নিয়ে যাচিছল। আর বলছিল, তুমি যেনা করেছ এবং চুরি করেছ। মেয়ে লোকটি বলছিল,‘আল্লাহ আমার জন্য যথেষ্ট এবং তিনিই আমার উত্তম অভিভাবক’। শিশুটির মা বলল, ‘হে আল্লাহ! তুমি আমার সন্তানকে এই নষ্টা নারীর মত কর না’। শিশুটি দুধ পান ছেড়ে দিয়ে মেয়েটির দিকে তাকাল,অতঃপর বলল,‘হে আল্লাহ!
তুমি আমাকে এই নারীর মত কর’ এ সময় মা ও শিশুটির মধ্যে কথা কাটাকাটি শুরু হয়ে গেল। মা বলল,হায়দুর্ভাগা! একটি সুশ্রী লোক চলে যাওয়ার সময় আমি বললাম,হে আল্লাহ! আমার সন্তানকে এরূপ যোগ্য করে দাও’। তুমি প্রত্যুত্তরে বললে,‘হে আল্লাহ্! আমাকে এর মত কর না’। আবার এই ক্রীতদাসীকে লোকেরা মারধর করতে করতে নিয়ে যাচেছ এবং বলছে,তুমি যেনা করেছ এবং চুরি করেছ। আমি বললাম,‘হে আল্লাহ! আমার সন্তানকে এরূপ কর না’। আর তুমি বললে,‘হে আল্লাহ! তুমি আমাকে এরূপ কর’। শিশুটি এবার জবাব দিল,প্রথম ব্যক্তি ছিল সৈরাচারী যালেম।সেজন্যই আমি বললাম,‘হে আল্লাহ! আমাকে এ ব্যক্তির মত কর না। আর এই মহিলাটিকে তারা বলল,তুমি যেনা করেছ। প্রকৃতপক্ষে সে যেনা করেনি। তারা বলছিল,তুমি চুরি করেছ। আসলে সে চুরি করেনি। এজন্যই আমি বললাম,‘হে আল্লাহ! আমাকে এই মেয়ে লোকটির মত কর’।
[বুখারী হা/৩৪৩৬ ‘নবীদের কাহিনী’ অধ্যায়, অনুচেছদ-৪৮, হা/২৪৮২ ‘মাযালিম’ অধ্যায়, অনুচেছদ-৩৫; মুসলিম হা/২৫৫০ ‘সদ্ব্যবহার ও শিষ্টাচার’ অধ্যায়, অনুচেছদ-২]
শিক্ষা:
- আল্লাহর উপর পূর্ণ আস্থা থাকলে কেউ পদস্খলন ঘটাতে পারবে না।
- কোন হক্বপন্থী ব্যক্তির বিরুদ্ধে যতই ষড়যন্ত্র করা হোক না কেন, তা একদিন সত্যরূপে প্রকাশিত হবেই এবং ষড়যন্ত্রকারীরা লজ্জিত হবে।
- আমরা যাকে ভাল মনে করি,প্রকৃতপক্ষে সে ভাল নাও হ’তে পারে।
- পক্ষান্তরে যাকে খারাপ মনে করি,প্রকৃতপক্ষে সে খারাপ নাও হ’তে পারে।
- সর্বদা পিতা-মাতার প্রতি সদ্ব্যবহার করতে হবে।
সুতরা সম্পর্কিত সুন্নাত
নবী করীম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “যখন তোমাদের কেউ সালাত আদায় করে, সুতরার দিকে সালাত আদায় কর। এর কাছাকছি দাড়াও এবং তোমার এবং এটির মধ্যে কাউকে অতিক্রম করতে দিওনা।”
সুতরা দেয়ার দালীলটি সাধারণ- মসজিদ কিংবা বাড়ি, নারী কিংবা পুরুষ সবার জন্যই। কিছু লোকেরা এই সুন্নাহকে অবলম্বন করে না, সুতরাং তারা সুতরা ছাড়া সালাত আদায় করে। এই সুন্নাহটি একজন মুসলিম দিনে রাতে বহুবার পুনরাবৃত্তি করে থাকে পাঁচ ওয়াক্ত সালাত, তাহিয়্যাত আল মসজিদ, বিতর ইত্যাদি সলাতে। জামা‘আতে সলাতের ক্ষেত্রে ইমামের সুতরাই মুক্তাদীদের জন্য সুতরা।
সুতরা সংক্রান্ত বিষয়সমূহ:-
১। সে সালাত আদায় করে তার সামনে কিবলার দিকে সুতরা নির্ধারণ করা হয়, যেমন- দেয়াল, লাঠি কিংবা খুঁটি। এর প্রশ্বস্ততার কোন সীমা নেই।
২। এটা কমপক্ষে বাহনের পিছনের পিঠের কাঠখন্ড সদৃশ বস্তুর সমান উচু হবে (প্রায় এক বিঘত পরিমান) ।
৩। দাঁড়ানোর জায়গা থেকে সুতরার দুরত্ব হবে তিন হাত।
৪। সুতরা ইমাম, একাকী সালাত আদায়কারী ব্যক্তি, ফারদ কিংবা নফল সব সলাতেই সুতরার বিধান রয়েছে।
৫। ইমামের সুতরাই মুক্তাদীদের সুতরা, কাতারের মধ্য দিয়ে হেটে যাওয়া বৈধ।
এই সুন্নাহগুলো পালন করার উপকারিতা:-
‣ এটি সালাত ভংগ হওয়া থেকে রক্ষা করে।
‣ এটি ঐ ব্যক্তিকে এদিক সেদিক তাকানো থেকে রক্ষা করে। এটি সালাতকে পরিপূর্ণ করতে সাহায্য করে ।
‘ব্যভিচার করা’
আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿وَلَا تَقۡرَبُواْ ٱلزِّنَىٰٓۖ إِنَّهُۥ كَانَ فَٰحِشَةٗ وَسَآءَ سَبِيلٗا ٣٢﴾ [الاسراء: ٣٢]
“তোমরা ব্যভিচারের কাছেও যেও না। নিশ্চয় এটা অশ্লীল কাজ ও অতি মন্দ পথ।” [সূরা আল-ইসরা, আয়াত: ৩২]
রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«إذا زنى العبد خرج منه الإيمان فكان على رأسه كالظلة فإذا أقلع رجع إليه»
“যখন কোনো মানুষ ব্যভিচারে লিপ্ত হয়, তখন তার থেকে ঈমান বের হয়ে যায়। ঈমান তার মাথার উপর ছায়ার মতো অবস্থান করে যাখন সে বিরত থাকে ঈমান আবার ফিরে আসে।” [তিরমিযী, হাদীস নং ২৫৪৯]
রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«كتب على ابن آدم نصيبه من الزنا مدرك ذلك لا محالة فالعينان زناهما النظر والأذنان زناهما الاستماع واللسان زناهما الكلام واليد زناهما البطش والرجل زناهما الخطى والقلب يهوي ويتمنى ويصدق ذلك الفرج».
“আদম সন্তানের ওপর ব্যভিচারের কিছু অংশ লিপিবদ্ধ হয়েছে, সে অবশ্যই তার মধ্যে লিপ্ত হবে। দুই চক্ষুর ব্যভিচার হলো দৃষ্টি এবং তার দুই কানের ব্যভিচার শ্রবণ, মুখের ব্যভিচার হলো কথা বলা, হাতের ব্যভিচার হলো স্পর্শ করা ও পায়ের ব্যভিচার হলো পদক্ষেপ আর অন্তরে ব্যভিচারের আশা ও ইচ্ছার সঞ্চার হয়, অবশেষে লজ্জাস্থান একে সত্যে অথবা মিথ্যায় পরিণত করে।” [সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ৪৮০২।]