মহিলাদের মাসআলা

প্রথমতঃ সূলুল্লাহ ﷺ -এর পবিত্র হাদীসে স্পষ্টভাবেই নারী-পুরুষের নামাজের কয়েকটি ভিন্নতার কথা বর্ণিত হয়েছে। এ ভিন্নতার কথা বর্ণিত হয়েছে সাহাবায়ে কেরামের পবিত্র ফতোয়া ও বাণীতেও। দীর্ঘ প্রায় দেড় হাজার বছরের ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যায়, তা এমনই শক্তিশালী দলীলসমৃদ্ধ যে, সাহাবীযুগ থেকে শুরু করে প্রত্যেক যুগেরই বরেণ্য ফকীহ ও মুহাদ্দিসগণ এবং মুজতাহিদ ইমামগণ এ ভিন্নতার পক্ষেই তাদের মত ব্যক্ত করেছেন। তাঁদের সংকলিত ও রচিত বিভিন্ন হাদীসের কিতাব, হাদীসের কিতাবের ব্যাখ্যাগ্রন্থ, ফিকহী রচনা—এসবই এর প্রমাণ বহন করে। যার কারণে পৃথিবীর দেশে দেশে মুসলিম নারীগণ তাদের নামাজে পুরুষদের সাথে যুগ যুগ ধরে যে ভিন্নতা রক্ষা করে চলছেন।

দ্বিতীয়তঃ নারী-পুরুষের নামাজের পার্থক্য নির্দেশ করে এমন কয়েকটি হাদীস :

১. তাবেয়ী ইয়াযীদ ইবনে আবী হাবীব রহ. বলেন, একবার রাসূলুল্লাহ ﷺ নামাজরত দুই মহিলার পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন। তখন তাদেরকে (সংশোধনের উদ্দেশ্যে ) বললেন,

إِذَا سَجَدْتُمَا فَضُمَّا بَعْضَ اللَّحْمِ إِلَى الأَرْضِ ، فَإِنَّ الْمَرْأَةَ لَيْسَتْ فِي ذَلِكَ كَالرَّجُلِ

‘যখন সেজদা করবে তখন শরীর জমিনের সাথে মিলিয়ে রাখবে। কেননা মহিলারা এ ক্ষেত্রে পুরুষদের মতো নয়।’ (কিতাবুল মারাসীল, ইমাম আবু দাউদ ৮০ সুুনানুলকুবরা, বাইহাকী ৩০১৬)

২. আবদুল্লাহ ইবনে উমর রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন,

إِذَا جَلَسْتِ الْمَرْأَةُ فِى الصَّلاَةِ وَضَعَتْ فَخِذَهَا عَلَى فَخِذِهَا الأُخْرَى ، وَإِذَا سَجَدْتْ أَلْصَقَتْ بَطْنَهَا فِى فَخِذَيْهَا كَأَسْتَرِ مَا يَكُونُ لَهَا ، وَإِنَّ اللَّهَ تَعَالَى يَنْظُرُ إِلَيْهَا وَيَقُولُ : يَا مَلاَئِكَتِى أُشْهِدُكُمْ أَنِّى قَدْ غَفَرْتُ لَهَا

‘কোনো নারী যখন নামাজে বসে তখন যেন সে তার (ডান) উরু অপর উরুর উপর রাখে। আর যখন সে সেজদা করে তখন যেন পেট উরুর সাথে মিলি রাখে; যা তার সতরের জন্যে অধিক উপযোগী। আল্লাহ তায়ালা তাকে দেখে (ফেরেশতাদের সম্বোধন করে) বলেন, হে আমার ফেরেশতারা! তোমরা সাক্ষী থেকো, আমি তাকে ক্ষমা করে দিলাম।’ (সুনানে কুবরা, বায়হাকী ৩৩২৪)

৩. ওয়াইল ইবনে হুজর রাযি. বলেন, একদিন আমি রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর দরবারে হাজির হলাম। তখন তিনি আমাকে (অনেক কথার সাথে একথাও) বলেছিলেন,

يا وائل بن حجر إذا صليت فاجعل يديك حذاء أذنيك والمرأة تجعل يديها حذاء ثدييها

‘হে ওয়াইল ইবনে হুজর! যখন তুমি নামাজ শুরু করবে তখন কান বরাবর হাত উঠাবে। আর মেয়েরা হাত উঠাবে বুক বরাবর। (আলমুজামুল কাবীর, তাবারানী ২৮)

উল্লেখিত হাদীসগুলো থেকে একথা স্পষ্ট হয়ে যায়, কিছু কিছু হুকুমের ক্ষেত্রে নারীদের নামাজ আদায়ের পদ্ধতি পুরুষের নামাজ আদায়ের পদ্ধতি থেকে ভিন্ন। বিশেষত ২নং হাদীসটি একথারও ইঙ্গিত করে—নারীদেরকে এমন পদ্ধতিতেই নামাজ পড়তে বলা হচ্ছে যা তার সতর ও পর্দার জন্যে সর্বাাধিক উপযোগী।

নারীদের নামাজের ভিন্ন পদ্ধতির বিষয়টি এমনই অকাট্য ও স্পষ্ট যে এর বিপরীতে কোনো একটি হাদীসও এমন পাওয়া যাবে না যাতে বলা হয়েছে, পুরুষ ও মহিলার নামাজের পদ্ধতিতে কোনো পার্থক্য নেই; বরং উভয়ের নামাজই এক ও অভিন্ন। সাহাবায়ে কেরামের সুবিশাল জামাতের একজনকেও এমন পাওয়া যাবে না, যিনি এই পার্থক্যকে অস্বীকার করেছেন। আমরা এখানে সাহাবায়ে কেরামের কয়েকটি ফতোয়াও উল্লেখ করছি —

সাহাবায়ে কেরামের কয়েকটি ফতোয়া:

১. আলী রাযি. বলেছেন,

إذا سجدت المرأة فلتحتفز ولتلصق فخذيها ببطنها

মহিলা যখন সেজদা করবে তখন সে যেন খুব জড়সড় ও সংকুচিত হয়ে সেজদা করে এবং উভয় উরু পেটের সাথে মিলিয়ে রাখে। (মুসান্নাফে আব্দুর রাযযাক ৫০৭২, মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বা ২/৩০৮, সুনানে কুবরা, বায়হাকী ২/২২২)

২. আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাযি.-কে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, মহিলা কীভাবে নামায আদায় করবে? তিনি বলেছেন,

تَجْتَمِعُ وَتَحْتَفِزُ

‘খুব জড়সড় হয়ে এক অঙ্গের সাথে আরেক অঙ্গ মিলিয়ে নামায় আদায় করবে।’ (মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা ২৭৯৪)

রাসূল ﷺ থেকে সাহাবায়েকেরাম যে দীন শিখেছেন, তাঁদের কাছ থেকে তা শিখেছেন তাবেয়ীগণ। তাঁদের ফতোয়া থেকেও এ কথাই প্রতীয়মান হয়—নারীদের নামাজ পুরুষের নামাজ থেকে ভিন্ন। ইমাম বুখারী রহ.এর শায়েখ ইমাম ইবনে আবী শায়বা রহ. তাঁর প্রসিদ্ধ হাদীস সংকলন ‘আলমুসান্নাফ’-এ তাবেয়ী হযরত আতা ইবনে আবী রাবাহ, ইবনে জুরাইজ, ইবরাহীম নাখায়ী, মুজাহিদ, যুহরী, হাসান বসরী, কাতাদা রাহিমাহুমুল্লাহু তায়ালা প্রমুখের ফতোয়া উল্লেখ করেছেন। তাঁরা সকলেই নারীদের জন্যে পুরুষের চেয়ে ভিন্ন নামাজ আদায়ের পদ্ধতির ফতোয়া দিয়েছেন। (বিস্তারিত দেখুন–মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা ১/২৭০,৩০২,৩০৩)

চার. সাহাবী ও তাবেয়ীযুগের সোনালী যুগের পর আসে মুজতাহিদ ইমামগণের যুগ। শত শত বছর ধরে বিশ্বব্যাপী প্রায় সকল মুসলমান মাসআলা-মাসায়েলের ক্ষেত্রে চারটি ফিকহী মাযহাবের অনুসরণ করে আসছে—হানাফী, মালেকী, শাফেয়ী ও হাম্বলী। এ চার মাযহাবের মধ্যে হানাফী মাযহাব সবচেয়ে পুরনো এবং এর অনুসারীর সংখ্যাও সর্বাধিক। এ মাযহাবের কেন্দ্রীয় ব্যক্তিত্ব ইমাম আজম আবু হানীফা রহ. তাবেয়ী হওয়ারও সৌভাগ্য অর্জন করেন। অন্য মাযহাবের কোনো ইমাম অবশ্য তাবেয়ী ছিলেন না। এ চার মাযহাবেরই এক স্বতঃসিদ্ধ মাসআলা—নারীদের নামাজ আদায়ের পদ্ধতি পুরুষের মতো নয়। (বিস্তারিত দেখুন–হানাফী ফিকহ: কিতাবুল আসার ১/৬০৯, জামিউল মাসানীদ ১/৪০০, সিআয়া ২/১৫৬,হিদায়া ১/১০০,১১০,১১১,বাদায়িউস সানায়ে ১/৪৬৬,আল মাবসূত ১/২৫ ফাতাওয়ায়ে শামী ১/৫০৪ ফাতাওয়ায়ে আলমগীরী ১/৭৩,৭৫; মালেকী ফিকহ:আয যাখীরা ২/১৯৩; শাফেয়ী ফিকহ:কিতাবুল উম্ম-১/১৩৮; হাম্বলী ফিকহ: আল মুগনী-২/১৩৯ )।

আল্লাহ আমাদের সকলকে সঠিক বুঝ দান করুন। আমীন।

নারী-পুরুষ নির্বিশেষে প্রাপ্তবয়স্ক সব মুসলিমের ওপর রমজানের রোজা ফরজ। স্বাভাবিকতই নারীদের রোজা পালনের ক্ষেত্রে বিশেষ কিছু মাসআলা ও সুযোগ রয়েছে, যেগুলো জেনে রাখা জরুরি।

♦ তিন দিন থেকে ১০ দিন পর্যন্ত যেকোনো মেয়াদে মাসিক ঋতুস্রাবকালীন নামাজ-রোজা বন্ধ রাখবে। কোনো কারণে ঋতুস্রাবের সময় ১০ দিনের চেয়ে বেড়ে গেলে নিজের আগের অভ্যাস অনুপাতে যে মেয়াদ রয়েছে, ওই দিন পর্যন্ত বন্ধ রেখে এর পর থেকে নামাজ-রোজা পালন করবে। আর যদি ১০ দিনের ভেতরই শেষ হয়ে যায়, তাহলে রক্ত আসার শেষ দিন পর্যন্ত ঋতুস্রাব গণ্য করে নামাজ-রোজা ইত্যাদি বন্ধ রাখবে। (আদ্দুররুল মুখতার : ১/৩০০-৩০১)

♦ নারী যদি নিজের ঋতুস্রাবের পবিত্রতার নিদর্শন দেখতে পায়; যার দ্বারা বুঝতে পারে যে সে এখন পবিত্র হতে যাচ্ছে, তাহলে রাতেই রোজার নিয়ত করবে। আর যদি পবিত্রতার নিদর্শন না দেখা যায়, তাহলে ভেতরে তুলাজাতীয় কিছু লাগিয়ে দেবে। যদি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকে, তাহলে রোজা রাখবে। যদি দ্বিতীয়বার হায়েজের রক্ত এসে যায়, তাহলে রোজা ভেঙে ফেলবে।

♦ নারী যদি নিজের অভ্যাস অনুযায়ী বুঝতে পারে যে, আগামীকাল তার ঋতুস্রাব হবে। তাহলেও সে রোজা ভাঙবে না। তবে ঋতুস্রাব দেখতে পেলে রোজা ভাঙবে।

♦ ঋতুবতী নারীর জন্য উত্তম হলো- নিজের স্বাভাবিক অবস্থায় থাকা। আল্লাহর ফয়সালার ওপর সন্তুষ্ট থাকা। ঋতুস্রাব বন্ধে কোনো কিছু ব্যবহার না করা। বরং ঋতু অবস্থায় রোজা ছেড়ে দেওয়া; যেহেতু শরিয়ত সুযোগ রেখেছে। পরে ঋতুস্রাবের সময়কালীন যে রোজাগুলো রাখতে পারেনি, সেগুলো কাজা করে নেওয়া। কেননা উম্মুল মুমিনিন ও আগেরকার পুণ্যবতী নারীরা এমনটিই করেছেন। তবে কেউ যদি ওষুধ দিয়ে রক্ত বন্ধ করে দেয়, তাহলেও রোজা হয়ে যাবে।

♦ ঋতুবতী নারীর জন্য উত্তম হলো- নিজের স্বাভাবিক অবস্থায় থাকা। আল্লাহর ফয়সালার ওপর সন্তুষ্ট থাকা। ঋতুস্রাব বন্ধে কোনো কিছু ব্যবহার না করা। বরং ঋতু অবস্থায় রোজা ছেড়ে দেওয়া; যেহেতু শরিয়ত সুযোগ রেখেছে। পরে ঋতুস্রাবের সময়কালীন যে রোজাগুলো রাখতে পারেনি, সেগুলো কাজা করে নেওয়া। কেননা উম্মুল মুমিনিন ও আগেরকার পুণ্যবতী নারীরা এমনটিই করেছেন। তবে কেউ যদি ওষুধ দিয়ে রক্ত বন্ধ করে দেয়, তাহলেও রোজা হয়ে যাবে।

♦ ঋতুবতী নারী যদি সূর্য হেলার আগেই যদি পবিত্র হয়ে যায় এবং রোজার নিয়ত করে, তাহলে তার ফরজ আদায় হবে না। (শামি, খণ্ড : ৩, পৃষ্ঠা : ৩৮৫)

♦ কোনো মেয়ে যদি প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পরও লজ্জায় তা মা-বোনের কাছে প্রকাশ করে না এবং রোজাও রাখে না; তাহলে তার ওপর তাওবা করা ও ছুটে যাওয়া রোজার কাজা করা ওয়াজিব।

পিরিয়ডকালে রোজার বিধান : রোজা রাখার পর দিনের বেলা পিরিয়ড শুরু হলে নারীর রোজা ভেঙে যায়। এমন নারীর জন্য খাওয়াদাওয়া করা বৈধ। তবে ওই দিন সম্ভব হলে রোজাদারদের সাদৃশ্য অবলম্বন করে পানাহার থেকে বিরত থাকবে।

কোনো নারীর যদি ফজরের আগেই পিরিয়ড শুরু হয়ে যায়, ওই নারীর জন্য দিনের বেলা খাওয়াদাওয়া করা বৈধ। তবে গোপনে পানাহার করা উচিত।

পিরিয়ডের কারণে রোজা না রেখে দিন শুরু করার পর পিরিয়ড বন্ধ হলে দিনের বাকি অংশ রোজাদারদের সাদৃশ্য অবলম্বন করে পানাহার বর্জন করবে। কিন্তু এই দিনের রোজাও পরে কাজা করে নিতে হবে। (বাহুরুর রায়েক : ২/২৯১)

রোজা অবস্থায় শিশুকে দুধ পান করালে রোজা ভঙ্গ হয় না।

রমজানের রাতে গোসল ফরজ হলে গোসল না করেও দিনে রোজা রাখা বৈধ। গোসল না করায় রোজার ক্ষতি হবে না। তবে ফরজ গোসলে বিলম্ব করা অনুচিত।
নারী যদি নিজের অভ্যাস অনুযায়ী বুঝতে পারে যে আগামীকাল তার পিরিয়ড শুরু হবে, তবু সে রোজা ভাঙবে না যতক্ষণ না সে তার পিরিয়ডের রক্ত দেখতে পায়।

রক্ত বন্ধে ওষুধ ব্যবহার অনুচিত : ঋতুমতী নারীর জন্য উত্তম হলো স্বাভাবিক অবস্থায় থাকা এবং আল্লাহর ফায়সালায় সন্তুষ্ট থাকা। ওষুধ ব্যবহার করে রক্ত বন্ধ রাখার প্রয়োজন নেই। কেননা ইসলামের মহীয়সী সব নারী এমনটাই করেছেন। তবে যদি ওষুধ দিয়ে রক্ত বন্ধ করে দেওয়া হয়, তাহলে রোজা রাখা যাবে এবং রোজা হয়ে যাবে।

অনেক নারী রোজা পালনের সুবিধার্থে ওষুধ খেয়ে স্রাব বন্ধ রাখেন। এতে যদি শারীরিক ক্ষতি না হয়, তাহলে কোনো অসুবিধা নেই।

সন্তান প্রসবকারী নারীর বিধান : নেফাসওয়ালা (সন্তান প্রসবকারী) নারী যদি ৪০ দিন হওয়ার আগেই পবিত্র হয়ে যায়, তাহলে রোজা রাখবে। তবে নামাজের জন্য গোসল করে নেবে। আর যদি ৪০ দিন অতিবাহিত হওয়ার পরও রক্ত চলমান থাকে, তাহলে সে রোজা রাখবে ও গোসল করে নেবে। কেননা তার রক্ত ইস্তেহাজা (রোগ) হিসেবে গণ্য করা হবে। ( শরহে বেকায়া : খ. ১, পৃ. ১২০)

অভিজ্ঞ ডাক্তার যদি অন্তঃসত্ত্বা নারীকে রোজা পালনে নিষেধ করে থাকেন, তাহলে ওই নারীর জন্য রোজা না রাখার অবকাশ আছে। সন্তান প্রসবের পর সুস্থতা লাভ করলে এই রোজা কাজা করে নিতে হবে। এর জন্য কাফফারা আদায় করতে হবে না।

অপবিত্রকালে নারীর ইবাদতের বিধান : নারীদের অপবিত্র থাকার সময়ে নামাজ পড়া, রোজা রাখা, কোরআন তিলাওয়াত ও মসজিদে প্রবেশ নিষিদ্ধ, যেভাবে তা অপবিত্র পুরুষের জন্য নিষিদ্ধ। কিন্তু তারা বিভিন্ন দোয়া-দরুদ, তাসবিহ-তাহলিল ও জিকির-আজকার করতে পারবে। এমনকি দোয়া হিসেবে আয়াতুল কুরসি ও কোরআনের বিভিন্ন আয়াত পাঠ করা যাবে। এতে সওয়াব পাওয়া যাবে, নিরাপত্তাও লাভ হবে।

পারিবারিক ও সামাজিক কারণে আমাদের দেশের নারীরা রমজানে কঠোর পরিশ্রম করে থাকে। বিশেষত সাহরি ও ইফতারের প্রস্তুতির ভার তাদেরই বহন করতে হয়। এ ক্ষেত্রে পুরুষের উচিত নারীদের যথাসম্ভব সহায়তা করা। কেননা পরিবার নারী-পুরুষ সবার। নারীরাও রক্তমাংসের মানুষ। তারাও রোজা রাখে। কাজেই তাদের ওপর অতিরিক্ত কাজের বোঝা চাপিয়ে দেওয়া অনুচিত। মহানবী (সা.) গৃহস্থালি কাজে তাঁর স্ত্রীদের সাহায্য করতেন। তাঁর জীবন ঈমানদারদের জন্য উত্তম আদর্শ।

ইসলামি শরিয়তের পরিভাষায় মহিলাদের মাসিক ঋতুচক্রকে হায়েজ বলে, আর প্রসবপরবর্তী স্রাবকে নেফাস বলে। হায়েজ ও নেফাসগ্রস্ত নারীদের জন্য নামাজ আদায় ও রমজানের রোজা রাখা জায়েজ নেই। এমতাবস্থায় যদি কেউ রোজা রাখেন কিংবা নামাজ আদায় করেন, তা হলে তারা শরিয়তের বিরুদ্ধাচরণ করবে।
ইসলামি বিশেষজ্ঞগণ সবাই ঐকমত্যের ভিত্তিতে বলেছেন, ঋতুবতী নারীর রমজানের ভাংতি রোজাগুলো অন্য যে কোনো মাসে কাজা করে দিতে হবে এবং এ ক্ষেত্রে কোনো কাফফারা আদায় করতে হবে না।

নারীদের রমজানের ভাংতি রোজাগুলো রমজানের পর যে কোনো মাসে নিকটতম সময়ে কাজা করে দিতে হবে। তবে রমজানের পর পরই কাজা আদায় করতে হবে—এমন কোনো বাধ্যবাধকতা নেই; বরং পরবর্তী রমজান শুরু হওয়ার আগে যে কোনো মাসে তা আদায় করা যায়।

এ মর্মে আম্মাজান আয়েশা (রা.)-এর বর্ণিত হাদিস বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তিনি বলেন, ‘রমজান মাসে আমার যে রোজাগুলো ছুটে যেত পরবর্তী শাবান মাসের মধ্যেই আমি তা কাজা করে ফেলতাম।’ (বুখারি ও মুসলিম)

যদি কোনো নারী শরিয়তসম্মত কারণবশত রমজানে তার ভাংতি রোজাগুলো পরবর্তী রমজান আসার আগে কাজা করতে না পারে, তবে রমজানের পরবর্তী সময় সেই (পূর্বের রমজানের) রোজাগুলো তাকে অবশ্যই কাজা করে নিতে হবে।

হানাফি আলেমরা বলেন, যদি কোনো নারী রমজানে তার ভাংতি রোজাগুলো পরবর্তী রমজান আসার আগে কাজা করতে না পারে, তার জন্য ফিদিয়া আদায় করতে হবে না; তার এই বিলম্বের জন্য শরিয়তসম্মত কোনো ওজর থাকুক বা না থাকুক। শুধু কাজা করে নিলেই চলবে।

তবে এ ব্যাপারে ইমাম মালেক, শাফেঈ এবং আহমদ (রহ.) -এর মত হলো, যদি তার এই বিলম্বের পেছনে শরিয়তসম্মত কোনো কারণ থাকে, তা হলে পরবর্তী সময় রোজাগুলো শুধু কাজা করে নিলেই চলবে।

আর যদি এই বিলম্বের পেছনে শরিয়তসম্মত কোনো কারণ না থাকে, তা হলে পরবর্তীতে রোজাগুলো কাজা করার পাশাপাশি প্রতিটি রোজার জন্য তাকে ফিদিয়া আদায় করতে হবে।

ঋতুচক্রের কারণে রমজানের ছুটে যাওয়া রোজাগুলো পরবর্তীতে লাগাতার রাখাটা জরুরি নয়; বরং নবীজি (সা.) বলেছেন, ছুটে যাওয়া রোজা লাগাতার কিংবা মাঝখানে সময় নিয়ে নিজের সুবিধামত রাখা যাবে। (দারাকুতনী)

সুতরাং মহিলাদের মাসিক ঋতুচক্রের কারণে রমজানের ভাংতি রোজাগুলো অবশ্যই পরবর্তী বছরের রমজান আসার আগেই কাজা করে নিতে হবে।

রোজা অতীব গুরুত্বপূর্ণ একটি মনোদৈহিক ইবাদত। রমজানের রোজা ইসলামের পঞ্চ স্তম্ভের অন্যতম। রোজার বিধান নারী ও পুরুষ সবার জন্য সমভাবে প্রযোজ্য। হাদিস শরিফে আছে: কোনো নারী যদি পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ ঠিকমতো আদায় করেন, রমজান মাসে পূর্ণরূপে রোজা পালন করেন, নিজের সম্ভ্রম ও ইজ্জত আবরু রক্ষা করে চলেন এবং স্বামীর অনুগত থাকেন; তিনি জান্নাতের আটটি দরজার যেকোনো দরজা দিয়ে ইচ্ছা হবে চাইলেই প্রবেশ করতে পারবেন। (সুনানে তিরমিজি)।

ঋতুমতী, গর্ভবতী এবং প্রসূতিদের রোজা ও নামাজ

রমজানে রজঃস্রাবের কারণে নারীরা তিন থেকে দশ দিন রোজা রাখতে পারেন না এবং নামাজও আদায় করতে পারেন না। অনুরূপভাবে নিফাস অবস্থায় অর্থাৎ সন্তান প্রসবোত্তর স্রাব চলাকালীন (সর্বোচ্চ ৪০ দিন) নামাজ ও রোজা পালন করতে পারেন না। এ সময়ের রোজাগুলো পরে আদায় করে নিতে হয়; কিন্তু এ সময়ের নামাজ আর আদায় করতে হয় না।

যেহেতু নিফাস বা প্রসবোত্তর স্রাবের সর্বনিম্ন কোনো সময় নেই; তাই স্রাব (রক্তক্ষরণ) বন্ধ হলেই নামাজ ও রোজা পালন শুরু করতে হবে (৪০ দিনের অপেক্ষায় থাকা যাবে না)।

অনেক নারী রোজা পালনের সুবিধার্থে ওষুধ খেয়ে রজঃস্রাব বন্ধ রাখেন। এতে যদি (বিজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শমতে) শারীরিক কোনো বড় ধরনের অসুবিধা না হয়; তাহলে কোনো অসুবিধা নেই।

রোজা অবস্থায় রজঃস্রাব হলে ওই দিনের রোজা হবে না; কিন্তু রমজানের সম্মানে সেদিন ইফতার পর্যন্ত তার পানাহার থেকে বিরত থাকা বাঞ্ছনীয়। পরদিন থেকে সুস্থ হওয়া পর্যন্ত রোজা রাখতে হবে না।

যাঁরা যেকোনো কারণে রোজা রাখতে পারেন না, তাঁরা রমজান মাসের রোজার সম্মানে ও রোজাদারদের সম্মানার্থে প্রকাশ্যে পানাহার থেকে বিরত থাকবেন।

কোনো নারী যদি রমজানের কোনো রাতে সাহরির সময় শেষ হওয়ার আগে স্রাব থেকে মুক্ত হন এবং যেকোনো কারণে গোসল করতে না পারেন; তাহলে সাহরি খেয়ে রোজা শুরু করবেন, পরে গোসল করে নামাজ আদায় করবেন।

বিশেষ সময়ের করণীয় আমল

নারীদের রজঃস্রাবের সময়ে নামাজ পড়া, রোজা রাখা, কোরআন তিলাওয়াত ও স্পর্শ করা এবং মসজিদে প্রবেশ করা নিষেধ। কিন্তু তাঁরা পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ বা নির্দিষ্ট ইবাদতের সময় হলে অজু করে এসে জায়নামাজ বিছিয়ে কিছু সময় বিভিন্ন দোয়া দরুদ, তাসবিহ তাহলিল ও জিকির আজকার করবেন; এতে তিনি সম্পাদিত আমলের ও সময় নির্ধারিত আমলের সওয়াব লাভ করবেন।

অনেকে মনে করেন অন্তঃসত্ত্বা নারী রোজা পালন করলে সন্তানের কোনো ক্ষতি হতে পারে; তাই তাঁরা রোজা না রেখে তার ফিদইয়া দিতে চান; এটা মোটেই ঠিক নয়। যদি অবস্থা এমন হয় যে অভিজ্ঞ কোনো ডাক্তার, যিনি ধর্মীয় বিধানের গুরুত্ব ও রোজার সামগ্রিক দিক সম্বন্ধে যথাযথ ওয়াকিবহাল এবং অন্তঃসত্ত্বা নারীর শারীরিক ও মানসিক অবস্থা জানার পর তাঁকে রোজা পালনে নিষেধ করে থাকেন; তবে এই নারী সন্তান প্রসবের পর সুস্থতা লাভ করলে তখন এই রোজা কাজা আদায় করবেন। এ ক্ষেত্রে ফিদইয়া বা কাফফারা গ্রহণযোগ্য হবে না।

ফিদইয়া হলো শুধু তাঁদের জন্য, যাঁরা অসুস্থতা বা বার্ধক্যজনিত অক্ষমতার কারণে রোজা রাখতে পারছেন না, যে অসুস্থতা থেকে আর সুস্থ হওয়ার কোনো আশা বা সম্ভাবনা নেই। আর শুধু শুধু অহেতুক আশঙ্কায় রমজানের ফরজ রোজা ছেড়ে দেওয়া জায়েজ হবে না।

ইস্তিহাযা বা নারীদের অসুস্থতা

কোনো নারীর যদি তিন দিনের কম বা দশ দিনের বেশি সময় মাসিক পিরিয়ড হয় অথবা নিয়মিত পিরিয়ড হওয়ার পর পুনরায় রক্তক্ষরণ দেখা দেয়, একে ইস্তিহাযা বলা হয়। ইস্তিহাযা চলাকালীন নামাজও পড়তে হবে এবং রোজাও রাখতে হবে।

অনুরূপভাবে সন্তান প্রসবের চল্লিশ দিন পরও যদি রক্তপাত বন্ধ না হয়, তাহলে অজু-গোসল করে যথারীতি নামাজ আদায় করতে হবে এবং রোজাও পালন করতে হবে। এ উভয় অবস্থায় নফল নামাজ, নফল রোজা ও অন্যান্য সকল ফরজ, ওয়াজিব, সুন্নত, মোস্তাহাব ও নফল ইবাদত করা যাবে। তাওয়াফ, জিয়ারত এবং কোরআন তিলাওয়াত, স্পর্শ করাসহ সব ইবাদত করতে পারবেন।

দুধ পান করানো ও রক্ত বের হওয়া

রোজা অবস্থায় সন্তানকে দুধ পান করালে রোজা ভঙ্গ হবে না। এমনকি এমনিতে দুধ নিঃসরণ হলেও রোজার ক্ষতি হবে না। অনুরূপভাবে কাটা-ছেঁড়া বা ক্ষতস্থান থেকে রক্ত বা তরল বের হলে (তা যে পরিমাণই হোক না কেন) রোজার কোনো ক্ষতি হবে না। কারণ, রোজা শুধু পানাহার ও রতিক্রিয়া দ্বারাই বিনষ্ট হয়; অন্য কোনো কারণে তা নষ্ট হয় না।

উল্লেখ্য, রক্ত বের হওয়া বা তরল ক্ষরণ হওয়া অজু ভঙ্গের কারণ; রোজা ভঙ্গের কারণ নয়। তবে নারীদের ঋতুস্রাব বা প্রসবোত্তর স্রাব হলে রোজা ভঙ্গ হবে। এই রোজা পরে কাজা আদায় করতে হবে; তবে কাফফারা দেওয়া লাগবে না। (ফাতাওয়া মিসরিয়া)।

এমন কিছু কাজ রয়েছে যেগুলো করলে রোজা ভেঙে যায়। এগুলো নারী-পুরুষ সবার জন্য প্রযোজ্য। যেমন: ইচ্ছা করে বমি করা, বমির বেশির ভাগ মুখে আসার পর তা গিলে ফেলা, ইসলাম ত্যাগ করলে, কান বা নাক দিয়ে ওষুধ প্রবেশ করালে, রোজাদারকে জোর করে কেউ কিছু খাওয়ালে। এমন আরও অনেক কারণ রয়েছে, যেগুলোর ফলে রোজা ভেঙে যায়।

তবে পুরুষের চেয়ে নারীদের আলাদা কিছু কারণ রয়েছে। যার ফলে তাদের রোজা ভেঙে যায়।

যেসব কারণে নারীদের রোজা ভেঙ যায় এবং করণীয় কী–

হায়েজ ও নিফাসের কারণে নারীদের রোজা ভেঙে যায়। নবী করিম (সা.) বলেন: ‘যখন নারীদের হায়েজ হয়, তখন কি তারা নামাজ ও রোজা ত্যাগ করে না!?’ [সহিহ বুখারি (৩০৪)]

তাই কোনো নারীর হায়েজ কিংবা নিফাস শুরু হলে তার রোজা ভেঙে যাবে। এমনকি সেটা সূর্যাস্তের সামান্য কিছু সময় আগে হলেও। আর কোনো নারী যদি অনুভব করেন যে, তার হায়েজ শুরু হতে যাচ্ছে, কিন্তু সূর্যাস্তের আগপর্যন্ত রক্ত বের হয়নি, তাহলে তার রোজা শুদ্ধ হবে। সেদিনের রোজা তাকে কাজা করতে হবে না।

আর হায়েজ ও নিফাসগ্রস্ত নারীর রক্ত যদি রাত থাকতে বন্ধ হয়ে যায় এবং সঙ্গে সঙ্গে তিনি রোজার নিয়ত করেন, তাহলে গোসল করার আগেই রোজা ফজর হয়ে যায়। সে ক্ষেত্রে আলেমদের মতামত হচ্ছে তার রোজা শুদ্ধ হবে।

হায়েজবতী নারীর জন্য উত্তম হচ্ছে তার স্বাভাবিক মাসিক অব্যাহত রেখে আল্লাহ তার জন্য যা নির্ধারণ করে রেখেছেন সেটার ওপর সন্তুষ্ট থাকা। হায়েজ রোধকারী বা মাসিক বন্ধ করার জন্য কোনো কিছু ব্যবহার না করা। আল্লাহ তার থেকে যেভাবে গ্রহণ করেন সেটা মেনে নেয়া। আর হায়েজের সময় রোজা ভাঙা এবং পরবর্তী সময়ে সেই রোজা কাজা পালন করা। উম্মুল মুমিনগণ এবং সলফে সালেহীন নারীগণ এভাবেই রোজায় আমল করতেন। (স্থায়ী কমিটির ফতোয়াসমগ্র (১০/১৫১)) অর্থাৎ নারীদের যদি হায়েজ হয় অথবা নেফাজ হয় অর্থাৎ রক্তস্রাব হয়, তাহলে রোজা ভেঙে যাবে। এ ক্ষেত্রে শুধু কাজা রোজা আদায় করতে হবে। কাফফারা আদায় করতে হবে না। এটা আল্লাহ মেয়েদের বিশেষভাবে ছাড় দিয়েছেন। আর মাসিক অবস্থায় যে নামাজ কাজা হয়ে গেছে তা আদায় করতে হবে না।

তবে সহবাসের কারণে রোজা ভেঙে গেলে কাজা এবং কাফফারা দুটোই আদায় করতে হবে।

মাসআলা: মহিলারা তাদের ঘরে নামাযের স্থানে ইতিকাফ করবে। নামাযের জন্য পূর্ব থেকে কোন স্থান না থাকলে তা নির্দিষ্ট করে নিবে। এরপর সেখানে ইতিকাফ করবে।

মাসআলা: যে মহিলার স্বামী বৃদ্ধ, অসুস্থ বা তার ছোট ছেলে-মেয়ে রয়েছে এবং তাদের সেবা করার কেউ নেই, সে মহিলার জন্য ইতিকাফের চেয়ে তাদের খেদমত ও সেবাযত্ম করা উত্তম।

মাসআলা: মাসিক (ঋতুস্রাব) অবস্থায় ইতিকাফ করা সহীহ নয়। কারণ এ অবস্থায় রোযাই রাখা যায় না। আর মাসনূন ইতিকাফের জন্য রোযা রাখা জরুরি।

মাসআলা: মহিলাদের উচিত তাদের নির্দিষ্ট দিনগুলোর শরু-শেষের দিকে লক্ষ্য রেখে ইতিকাফ করা।

মাসআলা: মহিলারা তাদের ইতিকাফের নির্দিষ্ট স্থান থেকে ঘরের অন্যত্র যাবে না। অন্যত্র গেলে ইতিকাফ ভেঙ্গে যাবে।

মাসআলা: মহিলাদের ইতিকাফ করতে হলে স্বামীর অনুমতি নিয়েই ইতিকাফ করতে হবে। স্বামীর নিষেধ সত্ত্বেও ইতিকাফ করলে ইতিকাফ সহীহ হবে না।

© 2023 Ramadan Prayers | Kanzul Hikmah iT Team